বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সাল একটি রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে উঠে এসেছে। চাকরির কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া সহিংসতার ঘটনায় এবার কাঠগড়ায় দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)। তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মামলা দায়ের করল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (International Crimes Tribunal – ICT)। রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
অভিযোগের সারাংশ
প্রসিকিউশনের দাবি, ছাত্র আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলিকে আন্দোলন দমন করার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশেই একাধিক ছাত্র-ছাত্রী এবং সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি “গণহত্যায় প্ররোচনা, সহায়তা, ষড়যন্ত্র এবং প্রতিরোধে ব্যর্থতার” দায়ে অভিযুক্ত।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, “এজেন্সির গোপন বার্তা, ভিডিও ফুটেজ ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ঘটনাগুলি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, বরং পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত হয়েছিল। শেখ হাসিনা নিজে এসবের নেতৃত্ব দিয়েছেন, অথবা প্রশ্রয় দিয়েছেন।”
অভিযুক্ত আরও দুই শীর্ষ ব্যক্তি
শুধু শেখ হাসিনা নন, মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন আরও দুইজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি:
- তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল
- তৎকালীন পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রসিকিউশনের মতে, এঁরা সকলে একত্রে একটি রাষ্ট্রীয় দমনযন্ত্র হিসেবে কাজ করেছেন, যার ফলেই ঘটে এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
কীভাবে শুরু হয়েছিল আন্দোলন?
২০২৪ সালের শুরুর দিকে সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থার সংস্কার দাবিতে ছাত্র সমাজ রাস্তায় নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন শুরু হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যদিও শুরুটা ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আন্দোলন রূপ নেয় সহিংসতায়। শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের উপর চরম দমন নীতির অভিযোগ ওঠে প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
কীভাবে শেষ হয় অধ্যায়?
- ৫ আগস্ট ২০২৪: টানা আন্দোলনের চাপে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ভারতে চলে আসেন।
- অক্টোবর ২০২৪: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
- ২০২৫ সালের মে মাস: ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার শুনানি শুরু হয়।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রায় ১,৪০০ জন প্রাণ হারান। অধিকাংশ মৃত্যু ঘটে পুলিশি গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও দলীয় ক্যাডারদের হামলায়। অভিযোগে বলা হয়েছে, এই মৃত্যুগুলি সরকার-নির্দেশিত দমননীতির ফল।
আরও পড়ুন: ট্রেন যাত্রার সময় সমস্যা? রেলের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অভিযোগ জানালেই মিলবে দ্রুত সমাধান
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই মামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে। ইতিমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ ইউনুসের প্রশাসন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের সব কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করেছে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, আজ সেই ট্রাইব্যুনালই তাঁর বিচার করছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়ের প্রশ্নে এই মামলার রায় হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি বিচারের প্রশ্ন নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিবেশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় রচনা করতে চলেছে। শেখ হাসিনা এই মামলা নিয়ে কী পদক্ষেপ নেন, তা এখন সময়ের অপেক্ষা।