হেলে পড়া বিশ্বাসের স্মারক, রহস্যে মোড়া বারাণসীর রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির

Ratneshwar Mahadev: প্রাচীন কাশীর গলিপথ আর ঘাটের শহরে, যেখানে ধর্ম, ইতিহাস আর আধ্যাত্মিকতা মিশে গেছে এক অলৌকিক আবহে— সেখানেই নিরবে দাঁড়িয়ে আছে এক বিস্ময়! রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির। চোখ ধাঁধানো কোনও চূড়া নয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত ধ্বংসস্তূপও নয় — বরং এক হেলে পড়া, কিন্তু অটুট, আস্থা আর আখ্যানের জ্যান্ত স্থাপত্য। স্থানীয়রা একে বলেন “কাশী করবত” — কারণ করবত শব্দের মানেই ‘হেলে পড়া’। আর এই মন্দির? পিছনের দিকে হেলানো প্রায় ৯ ডিগ্রি কোণে, যা ইতালির পিসার হেলানো মিনারের তুলনাতেও বেশি।

মন্দির না কি নিঃশব্দ প্রতীক?

এই মন্দিরটি বারাণসীর বিখ্যাত মানিকর্ণিকা ঘাটের লাগোয়া, অথচ যেন চিরকাল লোকচক্ষুর আড়ালে। গঙ্গার জলে ঘেরা, বর্ষাকালে যার গর্ভগৃহ জলে ডুবে থাকে — এই মন্দিরে বছরের অনেকটা সময় পূজাও হয় জলের নিচে। এই নিঃশব্দতাই যেন এক প্রকার আধ্যাত্মিকতা বয়ে আনে, যা শহরের কোলাহলে হারিয়ে যায়।

পিছনে কেন হেলে গেল মন্দির? রহস্যে গল্প, ইতিহাসে ইঙ্গিত

এই হেলানোর কোনও নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই আজও। ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, এটি নাগর শৈলীতে নির্মিত, এবং ১৮৬০-এর দশক থেকে ধীরে ধীরে হেলতে শুরু করে। কিন্তু এই বাস্তবতার পাশাপাশি মিশে গেছে একাধিক কিংবদন্তিও—

এক কাহিনি অনুযায়ী, রাজা মানসিংহের এক ভৃত্য তাঁর মা রত্নাবাঈ-এর নামে এই মন্দির নির্মাণ করেন। মা’কে উৎসর্গ করে গর্বভরে বলেছিলেন, “মায়ের ঋণ শোধ করলাম!”— আর সেখানেই জন্ম নেয় দেবতার অসন্তোষ। মন্দির হেলে পড়ে, যেন সেই উচ্চারণে ধরা পড়ে মানব অহং। ঈশ্বর যেন মনে করিয়ে দেন, “মায়ের ঋণ শোধ হয় না, তা কেবল মাথায় বয়ে বেড়ানো যায়।”

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Instagram Group Join Now

আরেকটি কিংবদন্তি বলছে, ইন্দোরের রানী অহল্যাবাঈ হোলকারের সেবিকা ছিলেন রত্নাবাঈ। নিজের নামে মন্দির নির্মাণ করায় রানীর রোষে অভিশপ্ত হয় মন্দিরটি — ফলত হেলানো স্থিতি যেন এক চিরন্তন শাস্তি।

ডুবে থাকা মন্দির, জেগে থাকা আস্থা

বর্ষা এলেই গঙ্গার জল বাড়ে। তখন এই মন্দিরের ভিতরকার অংশ থাকে সম্পূর্ণ ডুবে। স্থানীয়রা বলেন, এই সময়কার পূজা এক নীরব তপস্যার মতো — কেউ কেউ জলে নেমে করেন আরাধনা, কেউ স্থগিত রাখেন, কিন্তু বিশ্বাস থামে না।

স্থানীয় মাঝি রজনাথ তিওয়ারি বলেন, “পিসার মিনার দেখতে অনেক বিদেশি যায়, অথচ আমরা নিজেদের দেশে এমন এক মন্দির থাকা সত্ত্বেও তাকে ভুলে যাই। এটা শুধু ইট-পাথরের গঠন নয়, এটা আমাদের বিশ্বাস, ইতিহাস, ঋণ আর বিনয়ের চিহ্ন।”

আরও পড়ুন: Pahalgam Attack: নিশানা কি যুদ্ধ? সীমান্তে উত্তেজনার মাঝে সাধারণ নাগরিকদের প্রস্তুত রাখতে নির্দেশ কেন্দ্রের

বিজ্ঞান না বিশ্বাস?

বিভিন্ন ভৌগোলিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, নদীর ধারে নরম মাটি, জলস্তরের পরিবর্তন আর ভূমিকম্পীয় কম্পন মন্দিরের হেলিয়ে দেওয়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের কাছে এই মন্দির শুধুই একটি স্থাপত্য নয়— এটি এক ঋণের প্রতীক, আধ্যাত্মিক কাহিনির বাস্তব রূপ।

রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির হেলে পড়েছে, কিন্তু পড়ে যায়নি। যেমন আমাদের বিশ্বাস — যুগে যুগে ঝুঁকেছে নানা অভিঘাতে, তবু ভেঙে যায়নি। আজ যখন আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছেয় উড়ছে আধুনিকতা, তখন কাশীর গঙ্গার কোল ঘেঁষে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই মন্দির মনে করিয়ে দেয়— সত্যিকারের বিশ্বাস হেলেও, পড়ে না।

Leave a Comment